২০০৯ সালের ২৫ মে সুন্দরবন তছনছ করেছিল আয়লা। ২০২০ সালের ২০ মে আছড়ে পড়েছিল আমপান। এবার তছনছ করলো ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল। সারা দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে সুন্দরবনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। রক্ষা পেয়েছে খুলনা বাগেরহাট সাতক্ষীরা সহ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক এলাকা। যদিও সুন্দরবনের মধ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি রবিবার রাতে উপকূলে আঘাত হানে। রবিবার রাত আটটার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। ফলে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। এসময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত। বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাসেরও সৃষ্টি হয়েছে, তলিয়ে গেছে বসত বাড়ি ও ফসলের মাঠ।ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের তাণ্ডবে বরগুনার আমতলীতে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে।আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রেমাল এখনও উপকূল অতিক্রম করছে। এই সময়ে উপকূলজুড়ে ঝোড়ো হাওয়া ও অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, রেমালের কারণে সোমবারও উপকূলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হতে পারে। কোনো কোনো জায়গায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
এই আবহাওয়াবিদ আরও জানিয়েছেন, রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে পটুয়াখালীতে প্রতি ঘণ্টায় ১০২ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া রেকর্ড করা হয়েছে। সাড়ে ১১টায় খেপুপাড়ায় ৯১ কিলোমিটার, রাত ১১টা ৫৬ মিনিটে মোংলায় ৭৬ কিলোমিটার এবং এর আগে সিলেটেও প্রতি ঘণ্টায় ৪১ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া রেকর্ড করা হয়েছে। তার দাবি, কোনো কোনো জায়গায় বাতাসের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার।এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের আগে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে পড়ে গিয়ে শওকাত মোড়ল (৬৫) নামের এক ব্যক্তি মারা যান। অন্যদিকে রেমালের প্রভাবে উচ্চ জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে শরীফুল ইসলাম (২৪) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার দুপুরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।এছাড়া এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার চরফ্যাশন উপজেলায়। প্লাবিত হয়ে জেলায় ২০ হাজার মানুষ ঘরবন্দি রয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।জানা যায়, সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের রামদাসপুর, ভোলার চর, কানিবগার চর, চর মোহাম্মদ; চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগর ইউনিয়ন; লালমোহন উপজেলার চর কচুয়া, চর শাহাজালাল; তজুমদ্দিন উপজেলার চর মোজাম্মেল, চর জহিরুদ্দিন; বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুরসহ ৭৪টি দুর্গম চরাঞ্চলে ২০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।জেলা দুর্যোগকালীন কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে, ভোলার আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ ও প্রায় দুই হাজার গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের শুকনো খাবার সরবরাহ করা হয়।রাত ৯টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত জেলার কোথাও মাঝারি কোথাও ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। চরফ্যাশন উপজেলার কুকরিমুকরি ও ঢালচরে অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাত ১২টায় বৃষ্টি না থাকলেও দমকা হাওয়া বইছে। রাত সাড়ে ৯টার পর থেকে পুরো জেলা অন্ধকারে নিমজ্জিত।জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের নগদ ১১ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা রয়েছে। এ ছাড়া চাল রয়েছে ২২২ টন, ঢেউটিন ২১৪ বান্ডিল, গৃহ নির্মাণ বাবদ ছয় লাখ ৪২ হাজার টাকা ও শুকনো খাবার দুই হাজার ২২৩ প্যাকেট রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. আরিফুজ্জামান জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছি। বেশ কিছু নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। ওই সব উপকূলের মানুষকে নিরাপদে আনা হয়েছে।পিরোজপুর প্রতিনিধি এস এম মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, রিমালের প্রভাবে সন্ধ্যা থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে বৃষ্টি ও বাতাসের তীব্রতা বেড়েছে, প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও বাড়ছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে পিরোজপুর জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার উপকূলবর্তী এলাকা। মঠবাড়িয়া ও ইন্দুরকানির উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সাপলেজা, বড়মাছু, ছোট মাসুয়া,খেতাচিড়া, মাঝেরচর, টিকিট কাটা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা এবং ইন্দুরকানি উপজেলার টগরা সাঈদখালি চর, কালাইয়সহ প্রায় অর্ধশত এলাকা দুই থেকে আড়াই ফুট পানির নিচে। এসব এলাকার মানুষজন আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও গবাদিপশু ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৯৫ টি সাইক্লোন সেন্টার ও ২৬৬ টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাতটি উপজেলায় আটটি কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। সাতটি উপজেলায় ৬৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
পিরোজপুর জেলায় ৩৩৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ থাকলেও অক্ষত রয়েছৈ মাত্র ১৪৪ কিলোমিটার। ফলে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে নিম্নাঞ্চল দুই থেকে আড়াই ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বাগেরহাটের উপকূল জুড়ে বৃষ্টির সঙ্গে প্রবল বেগে বাতাস বইছে। রাত পৌনে ১টা পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা উপড়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে৷ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে সম্পূর্ণ জেলা।
শরণখোলার রায়েন্দা এলাকা থেকে আলী আকবর জানান, শরণখোলায় প্রচণ্ড বাতাস ও বৃষ্টি হচ্ছে। নদীর পানি বেড়েছে। আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁদের।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনের চেয়ে রাতের জোয়ারে নদী ও খালগুলোর পানি দুই থেকে তিন ফুট বেশি পানি বেড়েছে। বেড়িবাঁধ ও সড়ক উপচে পানি প্রবেশ করেছে লোকালয়ে। এই অবস্থায় আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে বাগেরহাটবাসীর।জেলার উপকূলীয় দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোতে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।