কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মুনিরুল ইসলাম অভিনব কায়দায় এক ভুক্তভোগীর সাধারণ ডাইরি (জিডি) গ্রহণ করেছেন। প্রথমে জিডি নিতে না চাইলেও পরে ‘আপাতত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই’ লিখে দেওয়ার শর্তে জিডি নথিভুক্ত করেন ওসি। এভাবে জিডি গ্রহণ করে ওসি নিজেই ‘অপরাধ’ করেছেন বলে দাবি করেছেন আইনজীবীরা।
রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) ভূরুঙ্গামারী থানায় জিডিটি নথিভুক্ত করা হয়েছে। জিডি নং ৬৭৬। ওসি মুনিরুল ইসলাম এভাবে জিডি নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ঐ জিডির বাদী মো. সাজু মিয়া নামের এক ভুক্তভোগী। তিনি উপজেলার পাইকেরছড়া ইউনিয়নের ছিট পাইকেরছড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং ওই এলাকার একজন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ব্যবসায়ী। ভুল নাম্বারে পাঠানো টাকা ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে তিনি রবিবার ভূরঙ্গামারী থানায় জিডি করতে যান।
জিডি সূত্রে জানা গেছে, শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাতে সাজু মিয়া নিজের নগদ এজেন্ট একাউন্ট নাম্বার থেকে এক গ্রাহকের পার্সোনাল নগদ একাউন্ট নাম্বারে ১০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করার সময় একটি ডিজিট ভুলের কারণে তা আরেক জনের নম্বরে চলে যায়। তিনি ওই নম্বরে ফোন দিয়ে টাকা ফেরত চাইলে অপর প্রান্ত থেকে টাকা ফিরত দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। বিষয়টি নগদ কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারা এ নিয়ে থানায় জিডি করে সেই কপি তাদেরকে পাঠানোর পরামর্শ দেন। পরে রবিবার ভুক্তভোগী ভূরুঙ্গামারী থানায় জিডি করতে যান।
জিডির বাদী সাজু মিয়া বলেন, রবিবার থানায় জিডি করতে গেলে ওসি প্রথমে জিডি নিতে অস্বীকৃতি জানান। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি ওসিকে জানিয়ে বার বার অনুরোধ করলে ওসি শর্ত সাপেক্ষে জিডি নিতে সম্মত হন। কম্পিউটার টাইপ করে আনা জিডি আবেদনে হাতে লিখতে বাধ্য করেন ‘ আপাতত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই’ ।
সাজু মিয়া আরো বলেন, ‘ওসি প্রথমে জিডি নিতে চাচ্ছিলেন না। আমার এক সহকর্মী সহ অনেক অনুরোধ করার পর ওসি আমাদেরকে আবেদন লিখে আনতে বলেন। আমরা বাইর থেকে কম্পিউটার টাইপ করে ওসির কাছে আবেদন নিয়ে যাই। আবেদন দেখে ওসি শেষে লিখতে বলেন “আপাতত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই”। পরে আমরা ওই আবেদনের শেষে কথাটি হাতে লিখে দেই। সে অনুযায়ী অনলাইন জিডি করে তা নথিভুক্ত করেন ওসি। ’
জিডির কপিতে সাজু মিয়ার দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে বাদীর কাছে ‘ আপাতত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই’ বাক্য লিখে নিলেও একই জিডিতে দ্বৈত অবস্থান নিয়েছে থানা পুলিশ। ওসির স্বাক্ষর করা ওই জিডির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া পুলিশ কর্মকর্তাকে লেখা রয়েছে ‘ এই ডাইরি সংক্রান্তে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন’। জিডিতে এ ধরণের বাক্য ব্যবহারকে আইনের ব্যত্যয় এবং ওসির স্ববিরোধী অবস্থান বলে দাবি করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। এভাবে জিডি গ্রহণ করে ওসি আইন ভঙ্গ করেছেন বলে মতামত দিয়েছেন সিনিয়র আইনজীবীরা।
আইনজীবীরা বলছেন, ‘ অভিযোগকারী কোনও ব্যক্তি আমলযোগ্য কিংবা অধরতব্য অপরাধ এর যে কোনও বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে থানায় যান না কেন অফিসার ইনচার্জ আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। আমলযোগ্য হলে এফআইআর নেবেন, অন্যথায় জিডি নেবেন। আর জিডি নেওয়ার অর্থ হলো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।’
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও সাবেক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘ এভাবে জিডি নিয়ে ওসি নিজেই অপরাধ করেছেন। আবেদনকারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই কথাটি লিখলেও ওসি জিডি নথিভুক্ত করার সময় ওই কথা রাখতে পারেন না। এটা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এভাবে জিডি নিয়ে ওসি নিজেই অপরাধ করেছেন।’
এভাবে জিডি নেওয়ার কোনও আইনগত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ওসি মুনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ জিডির আবেদনকারী তদন্ত চাননি বলে ওভাবে লিখতে বলেছি। যারা জিডি করতে আসেন তাদেরকে আসলে আইনগত দিক বোঝাতে পারি না।’
জিডিটি থানার একজন অফিসারকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘ ওভাবে লেখা আছে নাকি!’ জিডিতে এভাবে স্ববিরোধী বাক্য লেখার আইনি ভিত্তি প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘ আমি আপনার সাথে আইনি তর্ক করতে পারবো না। সাক্ষাতে কথা বলবো।’ তবে ওসির এমন দাবিকে প্রত্যাখান করেছেন জিডির বাদী সাজু মিয়া। তিনি বলেন আমি টাকা ফেরত যেন পাই সেজন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে থানায় জিডি করতে গেছি।’