কাজী আতিক, খুলনা প্রতিনিধিঃ ১৩ অক্টোবর ২০২৫ , ৪:৪৪:১১
ধর্মীয় চিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে দিঘলিয়ার ৭ বছরের শিশু জিসানকে হত্যা করে প্রতিবেশী ফয়সাল। আর লাশ গুম করার জন্য সহযোগিতা করে তার মা-বাবা। শনিবার রাতে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ফয়সালের মা-বাবাকে থানা হেফাজতে নেয় পুলিশ। গতকাল রবিবার সকালে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তারা তিনজন স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে চাইলে দিঘলিয়া থানা পুলিশ দুপুরের পর তাদের আদালতে নিয়ে আসে। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১ এর বিচারক অমিত কুমার বিশ্বাস তাদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। পরে তাদের তিনজনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন বিচারক। এর আগে বেলা সোয়া ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী এবং মন্ডল মিলের শ্রমিকেরা একত্রিত হয়ে হত্যাকারী ফয়সালের বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দিঘলিয়া থানার জিআরও এএসআই ইমাম আলী।
তিনি বলেন, বিকেল ৪ টার আগে থানা পুলিশ ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লিটন কুমার মন্ডল তাদের তিনজনকে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১ এর কক্ষে নিয়ে আসে। প্রথমে হত্যাকারী ফয়সাল (২৬), পরবর্তীতে তার বাবা জিএম হান্নান (৫২) ও সর্বশেষ তার মা মাহিনুর বেগম (৪৫) ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। পরে তাদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
এদিকে সন্তান হারা জিসানের মায়ের আহাজারি যেন থামছেনা। ১২ বছর বয়সি বড়ো ছেলে রাশেদকে জড়িয়ে ধরে একের পর এক বিলাপ করে চলেছে। ‘আমার বাজান তো কোনো অন্যায় করে নাই। আমার লগে ওদের কোনো শত্রুতা নাই। কেন ওরা আমার বাজানরে মাইরা ফালাইলো। কেমনে আমার বাজানরে খুন করল? আমি এইডার বিচার চাই। সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার বাবারে ওরা তিনোজনে যে কষ্ট দিছে, আমিও ওগো তিনজনরে সেই কষ্ট দিবার চাই। আমার বাবারে যেভাবে শাস্তি দিছে, আমিও ওদের সেভাবে শাস্তি চাই। আমি ওগো ফাঁসি চাই। আমার বাজান মসজিদ থেইক্যা নামাজ পইড়া বাহির হইছে বৃহস্পতিবারের দিন। ওই শয়তানও সাথে নামাজ পড়ছে। নামাজ পইড়া দু’জন একসাথে বাহির হইছে। এরপর আমার বাবারে হাত ধরে লইয়া কাম করছে’
বড় ছেলে রাশেদ নানা নানির সঙ্গে ভোলায় থাকে। ছোট ছেলে জিসান বাবা-মায়ের সঙ্গে দৌলতপুর-দেয়াড়া খেয়াঘাট সংলগ্ন মন্ডল টেক্সটাইল মিলের কোয়ার্টারে বসবাস করত। জিসানের বাবা আলমগীর হোসেন মন্ডল টেক্সটাইল মিলের মেকানিক্যাল বিভাগের শ্রমিক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লিটন কুমার মন্ডল বলেন, কয়েকমাস আগে তবলিগ জামায়াতে গিয়েছিল ফয়সাল। সেখান থেকে ফিরে এসে সে এলাকার সকলকে ইসলামি দাওয়াত দিত। এরই ধারাবাহিকতায় ৯ অক্টোবর বিকেল পৌনে ৫টার দিকে ইসলামের দাওয়াত দেয় ৭ বছরের শিশু জিসানকে। জিসান সেদিন নামাজ পড়ে ফয়সালের সাথে তাদের বাড়িতে যায়। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগে একটি দড়ি দিয়ে বেঁধে রান্নাঘর থেকে একটি দা এনে কুপিয়ে হত্যা করে জিসানকে। ঘটনাটি প্রথমে ফয়সালের মা মাহিনুর বেগম আঁচ করতে না পারলেও পরবর্তীতে সে জানতে পারে তার ছেলে একটি শিশুকে হত্যা করেছে। এরপর খবর দেওয়া হয় ফয়সালের বাবা হান্নানকে। তারা উভয়ে লাশটি গুম করার জন্য প্রথমে প্লাস্টিকের বস্তায় এবং পরবর্তীতে একটি চটের বস্তায় করে বাড়ির পূর্ব পাশের দেওয়ালের কাছে মাটি চাপা দেয় শিশু জিসানকে। হত্যার জন্য ফয়সাল ২০ মিনিট সময় নেয়।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি যাতে কেউ আঁচ করতে না পারে সেজন্য মাটির উপর রোদে শুকানোর জন্য পাটখড়ি সাজিয়ে রাখে তারা। তিনি বলেন, ফয়সাল প্রায় জিসানকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে প্রায়ই নাকচ করে দিত আর এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়।
দিঘলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এইচএম শাহীন বলেন, ‘কি কারণে কেন শিশু জিসানকে হত্যা করা করেছে এর উত্তর বের করার জন্য অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন। বাদির সাথে তাদের কোন শত্রুতাও ছিল না। প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ফয়সাল মাদকাসক্ত ছিল’।
হত্যার সঙ্গে জড়িত ফয়সালের চাচা জিএম আকরাম বলেন, ‘সরকারি সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ফয়সাল এসএসসি পাস করে। এরপর স্থানীয় একটি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে। ওদের স্বভাব চরিত্রের কারণে আমি খোঁজখবর রাখি না। মাঝেমধ্যে ওর মাথার ঠিক থাকতো না, পাগলামি করত। সমাজের জন্য ক্ষতিকর। ছোট ভাই হান্নানকে ওকে অনেকবার পাগলা গারদে দেওয়ার কথা বলেছি। আমার কথা শোনেনি।