কাজী আতিক, খুলনা প্রতিনিধিঃ ৫ অক্টোবর ২০২৫ , ৪:১৫:০৪
সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনায় নিজের নামে ১১ টি মামলা ছিল। ৫ আগস্টের পর বাদীকে নানাধরণের ভয়-ভীতি, হুমকি-ধামকি, সাক্ষীদের কোর্টে না যেতে ভয়-ভীতি দিয়ে ৮ টি মামলা প্রত্যাহার/খারিজ করতে সক্ষম হয়, চলমান রয়েছে ৩ টি। থেমে নেই তার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে আরও। অভিযোগ দিলে এলাকায় টিকতে পারবে না এ ভয়ে তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করতে সাহস করে না কেউ। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নের লাখোয়াটী গ্রামের প্রভাবশালী চার বাড়ির এক সময়ের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আনছার আলীর সেকেন্ড ইন কমান্ড আলোচিত আজিবার শেখ।
২০২৩ সালের মার্চে নগরীর শিরোমনি এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে শেখ আনছার আলী নিহত হওয়ার পর কিছুটা দমে যায় আজিবার। ৫ আগস্টের পর ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সে। আলোচিত আজিবার ওই গ্রামের মোনতার ওরফে মুনা শেখের পুত্র। তার কার্যকলাপে বিরক্ত প্রভাবশালী চার বাড়ির নিজের গোত্রের লোকজনও।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে বারাকপুর বাজারে তৎকালীন আলোচিত ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা গাজী জাকির হোসেনের উপর হামলার মধ্য দিয়ে এলাকায় আলোচিত আজিবার। সেদিন হামলা ও ভাঙচুর করা হয় তার বাড়িতে। ঘটনার ৪ দিন পর গাজী জাকির হোসেন বাদী হয়ে আজিবারসহ ১৩৪ জনের নামে দিঘলিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার নং ৪, তাং ২২/৪/২০২০।
একই দিন তার নেতৃত্বে হামলা করা হয় বারাকপুর বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও গাজী জাকির হোসেনের বড় ভাই গাজী নাসির উদ্দিন মাহমুদের বাড়িতে। ভাঙচুর করা হয় বাড়ির আসবাবপত্র। হামলায় গাজী নাসির উদ্দিন মারাত্মকভাবে আহত হন। ভেঙ্গে যায় তার ডান হাত। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে আজিবার শেখসহ ঘটনায় সম্পৃক্ত ১৭ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। মামলা নং ৪, তাং ২২/৪/২০২০।
এ ঘটনার একমাস ৬ দিন পর ২৪ মে প্রকাশ্য দিবালোকে বারাকপুর সন্ন্যাসী বাজারে গাজী জাকির হোসেনের চাচাতো ভাই গাজী মোস্তাককে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে মারাত্মক জখম কওে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আনছার আলী এবং আজিবার শেখের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনী। ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন মোস্তাক গাজী। এরপর থেকে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধীর ন্যায় জীবন যাপন করছেন। হামলার ক্ষতচিহ্ন এবং ভয় এখনও তাকে তাড়া করে। পিতার উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ছেলে মোঃ হাসিব গাজী বাদী হয়ে আজিবারসহ ঘটনায় সম্পৃক্ত ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করে। মামলা নং ৩, তাং ২৯/৫/২০২০।
এর একবছর পর ২০২১ সালের ২৬ মার্চ নন্দনপ্রতাপ ছোট ব্রিজ সংলগ্ন পাকা রাস্তার উপর গাজী জাকির হোসেনের ভাইপো গাজী সাহাগীর হোসেন পাভেলসহ তার সঙ্গে থাকা ৪/৫ জনের উপর হামলা করা হয়। ওই হামলার নেতৃত্বে ছিলেন আজিবার শেখ। ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত আজিবারসহ তার সহযোগীদের নামে খুলনা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট-২ মামলা দায়ের করা হয়। মামলা হলেও তখন আজিবার গ্রেপ্তার এড়িয়ে এলাকায় দাপটের সাথে চলাফেরা করত বলে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তার দাপট বেড়ে যায়। তার বিরুদ্ধে বারাকপুর এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, চাঁদাবাজি, হামলা ভাংচুর এবং লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। ৫ এবং ৬ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় পরপর দুইদিন গাজী নাসির উদ্দিনের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট করা হয়। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, হামলা ভাঙচুর লুটপাটের ঘটনার নেতৃত্বে ছিলো আজিবার নিজেই। এই ঘটনার পর ভয়, আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে গাজী নাসির উদ্দিন পরিবার পরিজন নিয়ে বারাকপুরের পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে শহরে চলে যান। এরপর মৃত্যুশয্যায় উপনীত নাসির গাজীর পরিবারকে নানা ধরনের ভয়-ভীতি, হুমকি-ধামকি দিয়ে পুরনো মামলা তুলে নিতে বাধ্য করেন আজিবার।
ভুক্তভোগীদের কাজ থেকে জানা যায়, শুধু নাসির গাজী নয়, তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মোস্তাক গাজীর উপর হামলার ঘটনার মামলাও ভয় ভীত এবং হুমকি দিয়ে তুলে নিতে বাধ্য করে। গাজী জাকির হোসেনের বাড়িতে হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা ৫ আগস্টের পর সাক্ষীদের নানা ধরনের হুমকি এবং ভয় দেখিয়ে আদালতে যেতে দেয়া হয়নি। যে কারণে দীর্ঘদিন সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।
গাজী নাসির উদ্দিন মাহমুদের স্ত্রী শিরিনা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ঘরবাড়ি ছেড়ে আসার পরও আমাদেরকে গালিগালাজ, ভয়-ভীতি হুমকি-ধামকিসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত ১ অক্টোবর সকালে বারাকপুর বাজার সংলগ্ন আমাদের বাড়ির বিক্রয়কৃত গাছ কাটতে থাকে গাছ ব্যবসায়ী ওমর শেখ এবং তার লোকজন। এ সময় আজিবার শেখ ঘটনাস্থলপ যেয়ে ওমর শেখকে গাছ কাটতে বাধা প্রদান করেন এবং তাকে শাসিয়ে বলেন, নাসির গাজী আমাকে ৫ লাখ টাকা না দিলে গাছ কাটতে দিব না। তাৎক্ষণিকভাবে ওমর শেখ বিষয়টি আমাকে তার ফোন থেকে কল করে জানায়। এ সময় আজিবার ওমর শেখের ফোন থেকে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, নানা ধরনের ভয়-ভীতি ও হুমকি ও ৫ লাখ টাকা না দিলে গাছ কাটতে দেওয়া হবে না বলে বলেন।
গাছ ব্যবসায়ী ওমর শেখ বলেন, “ঘটনার সময় আজিবার শেখ নামে এক লোক এসে বলে গাছ কাটা যাবে না, গাছ থেকে নেমে আসেন, এখান থেকে একটা কিছু নিতে দেবো না, একটা কোপও দেওয়া যাবে না। আমি তিন লাখ টাকা পাবো, নাসির গাজী আমারে কেসে দিল কেন?”
বিষয়টি শিরিনা আক্তার দিঘলিয়া থানায় মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছেন বলে জানা যায়। অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে দিঘলিয়া থানার এস আই মোঃ ফিরোজুল বলেন, “আজিবারের বিরুদ্ধে আমরা মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। ওসি স্যারের নির্দেশে তাকে থানায় ডেকেছি। তদন্ত সাপেক্ষে ঘটনার সত্যতা পেলে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, হুমকি-ধামকী, ভয়-ভীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আজিবার শেখ জানায়, “আওয়ামী লীগের আমলে নাসির গাজী আমার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা চাঁদা নিছে। আমার বিরুদ্ধে আর মামলা হবেনা এই বলে । কিন্তু নাসির গাজী কথা রাখেনি। চাঁদা দিয়েও রক্ষা পায়নি। আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েছে। ১ অক্টোবর নাসির গাজীর বাড়িতে গাছ কাটার ওখানে গিয়েছিলাম। আমি বলেছি আমার সাথে হিসাব নিকাশ না মিটিয়ে গাছ কাটা যাবে না। নন্দন প্রতাপের ঘটনায় অস্ত্রসহ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের ধরে থানায় দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা যেভাবে অত্যাচার করেছে, আমরা কিš সেভাবে কিছু করি নাই। মনের দুর্বলতার কারণে তারা ৫ আগস্টের পর এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এর জন্য আমরা দায়ী না। মোস্তাক গাজী এখন আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে। দেখা হলে আমারে ভাইডি বলে ডাকে। একসাথে বসে চা খাই।”
সে আরও জানায়, আমার নামে ১১ টি মামলা ছিল। জাকির গাজীর উপর হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৫৬ দিন জেলে ছিলাম। আরেকটি মামলায় কয়েকদিন জেলে ছিলাম। আপাতত কোন মামলা নেই। কিছু মামলা খারিজ হয়ে গেছে। তবে বাকী মামলাগুলো বাদিকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে প্রত্যাহারের কথা সে স্বীকার করেছে।
আজিবারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে দিঘলিয়া থানা অফিসার ইনচার্জ এইচএম শাহীন বলেন, “বর্তমানে আজীবার শেখের নামে ২০২০ সালে দায়েরকৃত তিনটি মামলা রয়েছে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, কিংবা যে কোন অপরাধের লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিব। এক্ষেত্রে আমরা কারো দলীয় পরিচয় দেখব না।”