তথ্যপ্রযুক্তি

চট্টগ্রামের স্কুলে স্কুলে অস্বাস্থ্যকর টয়লেটে বাড়ছে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি

  মো. সেলিম উদ্দিন খাঁন, চট্টগ্রাম ব্যুরোঃ ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ৬:০৪:৩২

চট্টগ্রাম নগরের একটি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী হঠাৎই ভেঙে পড়ল অসুস্থতায়। তীব্র যন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে, আর চিকিৎসকরা জানালেন ভয়াবহ খবর—সে প্রস্রাবের গুরুতর সংক্রমণে আক্রান্ত। টানা পাঁচদিন হাসপাতালে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশনের কড়া ডোজ নিতে হলো তাকে। বায়েজিদ এলাকা থেকে স্কুল ছুটির পর স্কুল বাসটি নগরের আন্দরকিল্লা এলাকায় পৌঁছাতেই সময় লেগে যায় প্রায় দুই ঘন্টা। এই পুরোটা সময় ধরে শিক্ষার্থীদের কারও প্রস্রাবের বেগ থাকলেও তাদের কিছু করার উপায় থাকে না। আবার স্কুলেও বাথরুমের অবস্থা এতোই নোংরা থাকে যে, শিক্ষার্থীরা সেখানে যেতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে সকাল ৭টায় স্কুলে গিয়ে বিকেল তিনটায় বাড়ি ফেরা পর্যন্ত এই শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ প্রস্রাবে ইনফেকশনের ছোট-বড় সমস্যায় ভোগে। পঞ্চম শ্রেণির ওই ছাত্রীর বেলায়ও একদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বন্দি থেকে টয়লেটে না যাওয়ার কষ্ট, আর অন্যদিকে স্কুলের নোংরা টয়লেটের প্রতি অনিচ্ছা—এই মিলিত যন্ত্রণা তাকে ঠেলে দিয়েছে হাসপাতালের শয্যায়।এ অভিজ্ঞতা কেবল এক ছাত্রীর নয়। চট্টগ্রাম নগরের অগণিত স্কুলে প্রতিদিন হাজারও শিক্ষার্থী একই দুরবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্কুলে কিংবা কোচিং সেন্টারে সময় কাটানো মেয়েরা টয়লেট ব্যবহার না করে চেপে রাখছে প্রস্রাব, কমিয়ে দিচ্ছে পানি পান, লজ্জায় কিংবা অস্বস্তিতে বাদ দিচ্ছে নিয়মিত ক্লাস। এর ফলেই বাড়ছে ইউরিনারি ইনফেকশন, কিডনির জটিলতা, এমনকি প্রজননজনিত সমস্যার ঝুঁকি। স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি ঋতুকালীন সময়ে মেয়েদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতিও মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের স্কুলগুলোর টয়লেট পরিস্থিতি শোচনীয়। অধিকাংশ টয়লেট অপরিষ্কার, পানির ব্যবস্থা নেই, দরজা নষ্ট, দুর্গন্ধে ভরা। পোস্তারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭০০ শিক্ষার্থীর জন্য আছে মাত্র তিনটি টয়লেট, যা ব্যবহারের অযোগ্য। ছাত্রীরা জানায়, এসব টয়লেট এতটাই নোংরা যে তারা স্কুলে থাকা অবস্থায় ব্যবহারই করে না, ফলে প্রস্রাব আটকে রাখতে হয়। এতে সংক্রমণ বাড়ছে, পানি কম খাওয়ার কারণে পেটব্যথা ও অন্য সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। আবার অনেক শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের টয়লেটে যেতে বাধা দেন বলে অভিযোগ মিলেছে।চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়মিত প্রস্রাব আটকে রাখা বিপজ্জনক। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউরোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. উজ্জ্বল বড়ুয়া অপু জানান, দীর্ঘ সময় প্রস্রাব আটকে রাখলে ইউরিনারি ইনফেকশন হয়, আর তা দীর্ঘস্থায়ী হলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। স্থানীয় স্কুলগুলোর বাস্তব চিত্র অনুসারে ১০ থেকে ১৯ বছরের মেয়েরা স্কুল ও কোচিংসহ ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা বাড়ির বাইরে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা না থাকা, অপরিষ্কার টয়লেট, ছাত্রীর তুলনায় টয়লেটের সংখ্যা কম ইত্যাদি কারণে ছাত্রীরা বিদ্যালয়ের টয়লেট ব্যবহার না করে একেবারে বাড়ি ফিরে টয়লেটে যায়। পানি কম খাওয়া, দীর্ঘক্ষণ টয়লেট ব্যবহার না করায় তাদের প্রস্রাবে সংক্রমণ, কিডনি ফেইলরসহ নানা প্রজনন সমস্যায় ভুগছে।সুদীপ্তা নামে এক ছাত্রী চলতি বছরের এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনদিন। তার ইউরিন ইনফেকশনসহ রক্তে জীবাণু ধরা পড়ে। হাসপাতালে থেকে কড়া ডোজের আন্টিবায়োটিক চিকিৎসা শেষে সুস্থ হতে হয় হয় সুদীপ্তাকে। পাঠানটুলী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী রেশমা আক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের স্কুলে কোনো হাইজেনিক কর্নার নেই। টয়লেটগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে সেখানে ঢোকা যায় না। দুর্গন্ধে অনেক সময় বমি আসে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছে, নোংরা টয়লেটের জন্য স্কুলের প্রতিই অনাগ্রহ চলে আসে তাদের। স্কুলে গেলেও সাধারণত টয়লেটে যায় না তারা, প্রস্রাব আটকে রাখে।
যা বলছেন চিকিৎসক,কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. প্রদীপ দত্ত বলেন, কিডনি শরীরের যে কাজটি করে তা হল শরীরের অতিরিক্ত পানি, লবণ ও বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। রক্তকে পরিষ্কার রাখে এবং শরীরের তরল ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখে। সেই অবস্থায় পানি কম খেলে প্রস্রাব ঘন হয়ে যায়। এর ফলে ইউরিক এসিড, ক্যালসিয়াম, অক্সালেট ইত্যাদি পদার্থ জমে গিয়ে কিডনিতে পাথর তৈরি হতে পারে। প্রস্রাব কম বের হলে টক্সিন জমে কিডনির উপর চাপ পড়ে। তাই নিয়মিত প্রস্রাব করা জরুরি। দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব চেপে রাখলে মূত্রাশয়ে জীবাণু বৃদ্ধি পায়। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) হতে পারে। ইনফেকশন বারবার হলে কিডনির উপর প্রভাব ফেলে। প্রস্রাব জমে থাকলে কিডনিতে চাপ সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে কিডনি ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়। তিনি আরো বলেন, কিডনি সুরক্ষায় প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা স্কুলে থাকাকালীন তৃষ্ণা পেলেই পানি খেতে হবে। প্রস্রাবের বেগ চেপে রাখা যাবে না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইউরোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. উজ্জ্বল বড়ুয়া অপু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রস্রাব আটকে রাখলে স্বাভাবিক প্রস্রাবের চক্রটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। প্রস্রাব বেশিক্ষণ ধরে রাখলে প্রস্রাবের ইনফেকশন দেখা যায়। আর দীর্ঘদিন ইউরিন ইনফেকশন থাকলে কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। তাই সময়মত টয়লেট ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি।’স্কুলে নোংরা টয়লেটের কষ্টে বিপন্ন শিক্ষার্থীরা সরেজমিনে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, সেখানে টয়লেটের অবস্থা শোচনীয়—নোংরা ও অপরিষ্কার। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিবেচনায় টয়লেটের সংখ্যাও অপর্যাপ্ত। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনায় ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে টয়লেটগুলো। নেই পর্যাপ্ত পানি ও পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা। অনেক টয়লেটের পানির কল অকেজো, নষ্ট দরজা পেরিয়ে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। আলাদা স্বাস্থ্যকর টয়লেট এবং হাইজেনিক কর্নার না থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে যায় ছাত্রীরা।
চট্টগ্রাম নগরীর পোস্তারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭০০ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে তিনটি টয়লেট। কিন্তু তিনটি টয়লেটই ব্যবহারের অযোগ্য। প্রতিদিন দিনের শুরুতে ও স্কুল ছুটির পর নিয়মিত টয়লেট পরিস্কার না হওয়ায় সেগুলো ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা থাকে। ডা, খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতি ভবনে রয়েছে একটি করে টয়লেট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানায়, প্রতিদিন স্কুলে আসার সময় তারা পানি অপেক্ষাকৃত কম পান করে আসে। কারণ তাদের স্কুলে মেয়েদের টয়লেটটি ভালো না। সেখানে যেতে হলে লাইন ধরতে হয়।তবে ব্যতিক্রমও আছে। অর্পণাচরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু তালেব জানান, তাদের স্কুলে ২২টি টয়লেট রয়েছে, যা প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করা হয় এবং এর জন্য আলাদা ক্লিনার নিয়োগ করা আছে। তিনি বলেন, ‘স্কুল প্রধান হিসেবে এ বিষয়টিতে আমি সবসময় নজর রাখার চেষ্টা করি।’এখনও অকার্যকর স্যানিটেশন নির্দেশনা, ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা,
জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে ২০১৫ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির নজরদারিতে আনতে হবে। ওই কমিটি এ খাতের জন্য পৃথক একটি সংরক্ষিত তহবিলের ব্যবস্থা করবে। টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলও নিয়োগ করবে। সংরক্ষিত তহবিল থেকে এ ব্যয় মেটানো যাবে। পরিপত্রে ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা, টয়লেটে ঢাকনাযুক্ত প্লাস্টিকের পাত্র রাখা, ঋতুকালীন (মাসিক) বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একজন শিক্ষিকাকে দায়িত্ব দেওয়া, স্যানিটারি ন্যাপকিন (প্রয়োজনে টাকার বিনিময়ে) রাখার কথাও ছিল। নিয়ম অনুযায়ী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুপেয় পানি, টয়লেট ব্যবস্থা, মেয়েদের পৃথক টয়লেট ব্যবস্থা, হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা আছে কিনা, সে বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা বা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকতে হয়।কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই পরিপত্র নির্দেশনা অধিকাংশ স্কুলে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির হার বাড়ছে।বাংলাদেশের ৪৩% স্কুলে মৌলিক স্যানিটেশন সুবিধা নেই,ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০টি স্কুলের চারটিতে (৪৩%) সাধারণ স্যানিটেশন সুবিধারও অভাব রয়েছে, যেখানে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট ও গোপনীয়তার ব্যবস্থা নেই। খুব কম স্কুলে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য হাইজিন সুবিধা রয়েছে। তথ্যপত্র অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ৫টি স্কুলের মধ্যে ১টিতে (১৯%) নিরাপদ পানীয় পানি নেই, যা প্রায় ৮৫ লাখ স্কুল শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করছে। প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ৭% স্কুলে কোনো হাইজিন সুবিধা নেই। অর্থাৎ ৩০ লাখেরও বেশি শিশু এমন স্কুলে পড়ছে যেখানে নিরাপদ পানীয় পানি নেই, টয়লেট নেই, এমনকি হাত ধোয়ার সুযোগও নেই।

আরও খবর