আইন-আদালত

সাতক্ষীরায় এক কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে ব্যবসায়ীকে নির্যাতন, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৫ জনের নামে মামলা

  জিয়াউল ইসলাম জিয়া,বিশেষ প্রতিনিধি ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ , ২:৪১:২৪


কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে অপহরণ করে নির্যাতনের অভিযোগে সাতক্ষীরা সদর সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সাবেক পিপিসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে বুধবার মামলা হয়েছে। সাতক্ষীরার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিলাস মন্ডলের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন দেবহাটা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো: আল ফেরদাউস আলফা। মামলা নং-সিআর ১৭৪২/২৫। ধারা-৪৪৮/৩৬৪/৩২৩/৩০৭সহ অন্যান্য। অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম বিলাস কুমার মণ্ডল আগামি ২০ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গোয়েন্দা, অপরাধ ও তদন্ত শাখার (সিআইডি) সাতক্ষীরার প্রধান কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

মামলার বাদী  আল ফেরদৌস আলফা জেলার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে বর্তমানে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলের বাসিন্দা হয়ে সাতক্ষীরার ১ নং আমলী আদালতে এ মামলা দায়ের করেন।

মামলার আসামীরা হলেন- সাতক্ষীরা সদর সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর্জা সালাউদ্দীন, সদর থানার সাবেক ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক ওসি মহিদুল ইসলাম, সদর উপজেলার কামারবায়সা গ্রামের ও বর্তমানে রসুলপুরের বাসিন্দা সাতক্ষীরা জজকোর্টের সাবেক পিপি আব্দুল লতিফ ও তার ছেলে মো: রাসেল।

মামলার বিবরণী থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁকাল চেকপোস্টে বাদীর দেড় কোটি টাকার ভারতীয় সামদ্রিক মাছ জব্দ করে বিজিবি। পরে বাদীর বৈধ কাগজপত্র বিজিবি’র কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু বিজিবি কাগজপত্র যথাযথ বুঝতে না পেরে সেই মাছ সাতক্ষীরা সদর থানায় প্রেরণ করে। বৈধ কাগজ পাঠালেও মাছ ছাড়া হবেনা- এমন হুমকি দিয়ে সদর থানার তৎকালীন ওসি মোস্তাফিজুর রহমান ফোনে বাদীর কাছে দেড় কোটি টাকা দাবি করেন। একপর্যায়ে বাদী ফোনের সুইস অফ করতে বাধ্য হন। এদিন রাত ১১ টার দিকে  সহকারি পুলিশ সুপার (সদর) মীর্জা সালাহউদ্দিন ও ডিবির ওসি মহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ১০/১২ জন অজ্ঞাতনামা পুলিশ দুটি মাইক্রোবাসে করে এসে আল ফেরদৌস আলফার পলাশপোলের বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি করার কথা বলে দরজা খুলতে বাধ্য করেন। দোতলা ও তিন তলার ঘরে সার্চ করে কিছু না পেয়ে আলফার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। আলফা তার ড্রয়ারে থাকা ১৫ লাখ টাকা দিলে তা থেকে কিছু টাকা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ও গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলামকে দেন মীর্জা সালাহউদ্দিন। পরে তাকে গুম করার উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা মহিদুলের নেতৃত্বে অজ্ঞাতনামা কয়েকেজন এক কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে আলফার দুচোখ ও দুই হাত বেঁধে গোয়েন্দা পুলিশের কথিত আয়নাঘর নামক ঘরে ঝুলিয়ে নির্যাতন করেন। ২৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে শৌচাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় আলফা একটি ঘরে মীর্জা সালাহউদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান ও মহিদুল ইসলামকে দেখেন। শৌচাগার থেকে ফেরার সময় মীর্জা সালাহউদ্দিন আলফাকে বলেন যে, তুই ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে মাছ এনেছিস। নির্যাতন সহ্য করবি না এক কোটি টাকা দিবি? মাছ গেছে তা আর পাবি না। জীবন বাঁচাতে কত দিবি? বৈধ কাগজপত্র আছে বলে সরকারকে রাজস্ব দিবি আর আমাদের এক কোটি টাকা দিবি না তা তো আর হয় না। ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন আলফা। টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় মোস্তাফিজুর রহমান ও মহিদুল ইসলামসহ কয়েকজন চোখ ও হাত বেঁধে আলফাকে ঝুলিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত আবারো অমানুষিক নির্যাতন করে। এসব নির্যাতনের কিছু অংশ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না মর্মে আলফা মামলায় উল্লেখ করেন।

টাকা না পাওয়ায় ৩০ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে আলফাকে আবারো নির্যাতন করে একটি মাইক্রোবাসে করে বাইপাস সড়কের নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন যে, ওযু করে নে আজ তোর জীবনের শেষ দিন। তোর মাছি বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসেছি। জান ফিরে ফেতে হলে তোকে আজ রাতের মধ্যে এক কোটি টাকা দিতে হবে। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় রাতভর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে ৩১ ডিসেম্বর ভোরে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে (কথিত আয়না ঘর) এনে নামাজ ও শৌচাগারে যাওয়ার সময় ব্যতীত বাকী সময়ে হাত, পা ও চোখ বেঁধে আলফাকে আবারো নির্যাতন করা হয়। এ সময় আলফা কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

৩১ ডিসেম্বর সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে আলফা ও ভাই আলিমকে একই গাড়িতে করে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয় থেকে সদর থানায় নিয়ে আসা হয়। বিকেলে তাদের দুই ভাইকে ২৯ ডিসেম্বর সামুদ্রিক মাছ অবৈধভাবে আনার অভিযোগে ৩০ ডিসেম্বর বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত মামলার মামলায় আদালতে পাঠানো হয়। আলফাকে এজাহার নামীয় ও আলিমকে সন্ধিগ্ধ আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালত থেকে ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি এক দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করানো হয়। রিমাণ্ড আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন করলে জেলা ও দায়রা জজ রিমাণ্ড আদেশ না’মঞ্জুর করেন। মীর্জা সালাহউদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান ও মহিদুল ইসলাম বিশেষ ব্যবস্থায় দেড় কোটি টাকার মাছ এক লাখ ৯৫ হাজার ৯২৫ টাকায় নিলাম করিয়ে জমা দেখান। আলফা ও আলীম ১৯ দিন কারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আলফা আদালতের নির্দেশে ওই টাকা ফেরৎ পান ও মামলা খারিজ হয়।

মামলার বিবরণীতে আরও বলা হয় মামলার জামিন করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বাদীর কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য করেন সাতক্ষীরা জজ আদালতের তৎকালীন পিপি আব্দুল লতিফ ও তার ছেলে মো: রাসেল।

আসামীদের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে বাদী তাঁর দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন ও আর্থিক এবং সামাজিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন, তাই আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করা হয়েছে আরজীতে। তৎকালীন সময়ে মামলার অনুকুল পরিবেশ না থাকায় মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে বলে আরজীতে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে বাদী পক্ষের আইনজীবী এড. খায়রুল বদিউজ্জামান বলেন, এ  মামলার পরবর্তী  ধার্য দিন নির্ধারিত হয়েছে ২০২৬ সালের ২০ এপ্রিল। এছাড়া বিচারিক হাকিম মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন।

আরও খবর