গণমাধ্যম

সাংবাদিক বুলুর মৃত্যু নিয়ে রহস্য, স্বজনদের দাবি হত্যাকাণ্ড

  কাজী আতিক, খুলনা প্রতিনিধি: ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ১২:২৮:৫১

খুলনায় সাংবাদিক ওয়াহেদ-উজ-জামানের মৃত্যু হত্যা না আত্মহত্যা—সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সহকর্মী ও স্বজনদের দাবি, এটি হত্যাকাণ্ড। শুরুতে পুলিশ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও এখন বলছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ওয়াহেদ-উজ-জামান তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন। মেজ ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক বছর আগে মারা যান। ছোট ভাই আনিছুজ্জামান দুলু ঢাকায় ব্যবসা করেন। নগরীর শিববাড়ি মোড়–সংলগ্ন ইব্রাহিম মিয়া রোডে তাঁদের পৈতৃক বাড়ি থাকলেও সেটি চার বছর আগে বিক্রি করা হয়। এরপর ওয়াহেদ-উজ-জামান সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। প্রায় চার মাস আগে তাঁর স্ত্রী নিখোঁজ হন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাগমারা এলাকায় নতুন বাসায় ওঠার কথা ছিল তাঁর।

ছোট ভাই আনিছুজ্জামান দুলু বলেন, গত মাসে ট্রেনের ধাক্কায় আহত হয়ে কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন বড়ভাই বুলু। তখন আমি তাঁকে ঢাকায় আসতে বলেছিলাম। আসার কথা বললেও আর আসেনি। তেমন কোনো বিষয়ই আমাদের সঙ্গে শেয়ার করত না। শনিবার রাতে শেষবার কথা হয়েছে। আমার কাছে এটা হত্যা মনে হচ্ছে। একটা ফোন তো অন্তত করবে বা একটা মেসেজ তো করবে যে ভাই আমার আর ভালো লাগছে না। সুস্থ একজন মানুষ হঠাৎ করে এভাবে মারা যেতে পারে না।’

এর সঙ্গে ভাই যোগ করলেন, ‘তাঁর চাকরিটা মনে হয় ঠিকমতো ছিল না। স্ত্রী নিখোঁজ হওয়ার পর মন খারাপ থাকত তাঁর। তবে কারও সঙ্গে শত্রুতা বা অন্য কোনো বিষয়ে আমাদের জানা নেই। শুনেছি সেতুর ওপর কারও সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল। এরপর তাঁকে ঝাঁপ দিতে দেখেছে সেখানকার একজন কর্মী।

ওয়াহেদ-উজ-জামানের শ্যালকের স্ত্রী নুরনাহার পারভীন বলেন, শুক্রবার ভাড়া করা নতুন বাসায় মালপত্র তুলেছিলেন তিনি। দুপুরে তাঁদের বাসায় খেয়েছেন, এরপর যশোরে আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন। শনিবার বিকেলেও তাঁদের বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে যান। রোববার সকালে নাশতা করে বেরিয়ে যান। এ সময় তিনি এক বোতল পানি ও একটা ক্যাপ চেয়ে নেন। দুপুরে ফোন করলে সেটি বন্ধ পান। রাতে তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারেন।

নুরনাহার পারভীন বলেন, ‘আমাদের ননদ (বুলুর স্ত্রী) নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তিনি মানসিকভাবে অশান্তিতে ছিলেন। কান্নাকাটি করতেন, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করতেন না। এ জন্য আমরা তাঁকে আমাদের কাছে থাকতে বলেছিলাম। তবে তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে বিশ্বাস করি না। বাসা থেকে সুস্থ মানুষ বের হয়েছিল। আমরা হত্যা বলেই মনে করছি। আমরা চাই পুলিশ ভালোভাবে তদন্ত করুক।’

খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের (কেইউজে) সভাপতি মহেন্দ্র নাথ সেন বলেন, ওয়াহেদ-উজ-জামান দীর্ঘদিন বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান।

কেএমপি সদর থানার নৌ–পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মহিদুল হক বলেন, স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ সেতুর ২ নম্বর পিলারের বেসমেন্টের ওপর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে। সুরতহালে দেখা গেছে মুখ থেঁতলানো, দুই হাত ও বাঁ পা ভাঙা। এখনই এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না।

আজ সোমবার দুপুরে চোখের জলে শ্রদ্ধা জানিয়ে ওহেদ-উজ-জামান বুলুকে শেষ বিদায় জানান সাংবাদিকেরা। স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনেরা তাঁর মৃত্যুকে ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ বলছেন, কেউ কেউ ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা’ আখ্যা দিয়েছেন। রহস্যজনক এ মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে খুলনার সাংবাদিক সমাজ।

রূপসা সেতুতে থাকা ভিডিও ফুটেজের বরাত দিয়ে কোস্ট গার্ডের সূত্র জানায়, রোববার দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে রূপসা সেতুর ওপর ঘোরাঘুরি করছিলেন সাংবাদিক বুলু। এ সময় তাঁর সঙ্গে এক নারী ছিলেন। তাঁদের দুজনকে ঝগড়া করতে দেখা গেছে। একপর্যায়ে বুলু সেতু থেকে নিচে লাফ দেন। ওই নারী তখন চিৎকার-চেঁচামেচি করে লোক ডাকেন। ওই নারীকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

রূপসা সেতুর ভিডিও ফুটেজের সুত্র ধরে বুলুর সহকর্মীদের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে, রূপসা সেতুতে যে নারী ছিলেন সে কে? তাহলে কি হানিট্রাপে তাকে সেতুতে নেয়া হয়েছিল।

খুলনা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক এনামুল হক বলেন, সাংবাদিক বুলুর মৃত্যুর ঘটনা প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা প্রচারিত হলেও এটি স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু নয়। এ মৃত্যুর পেছনে রহস্যজনক কোনো ঘটনা রয়েছে। রূপসা ব্রিজের সিসি ক্যামেরা ও বুলুর মোবাইল ফোন পরীক্ষা করা হলে এই হত্যা রহস্য উন্মোচিত হবে। তিনি আলোচনা সাপেক্ষে আন্দোলনে যাবার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

এদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আজ সোমবার দুপুরে প্রয়াত সাংবাদিক বুলুর লাশ খুলনা প্রেসক্লাবে আনা হয়। সেখানে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শেষ শ্রদ্ধা জানায় খুলনা প্রেসক্লাব, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, টিভি রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠন।

জানাজার আগে বুলুর ছোট ভাই আনিসুজ্জামান দুলু বলেন, ‘সাংবাদিক বুলুর মৃত্যু স্বাভাবিক হিসেবে আমরা দেখছি না।’ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে রহস্য উদঘাটনের দাবি জানান তিনি।

আরও খবর