অযত্ন-অবহেলায় শ্যামনগরের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি এখন মাদকসেবী-জুয়াড়িদের আড্ডাখানায় পরিনত হয়েছে। ১৩৭ বছরের পুরানো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরীর বাড়িটিতে রাতের আঁধারে মাদক সেবন আর অসামাজিক কার্যকলাপ এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। অথচ শ্যামনগর থানা সদরের দুই কিলোমিটারের মধ্যে এই বাড়িটির অবস্থান।
ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায়, জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরী ১৮৮৮ সালে ৪১ কক্ষের তিনতলা এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। জমিদার হরিচরণ রায় বাহাদুর ছিলেন একাধারে জনহিতৈষী ও প্রতাপশালী শাসক। তাঁর আমলে শ্যামনগর তথা সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় জনকল্যাণমূলক বহু কাজ সম্পন্ন হয়। লোককথা অনুযায়ী, তাঁর মা ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে গুপ্তধনের অবস্থান পেতেন, এ থেকেই নাকি হরিচরণ বিপুল সম্পদের মালিক হন এবং সূর্যাস্ত আইন প্রয়োগ করে তিনি বহু জমি কিনে স্বতন্ত্র জমিদারে পরিণত হন।
উপজেলার নকিপুর গ্রামের প্রবীন বাসিন্দা ডা. আব্দুল জলিলের মতে, লোক মুখে প্রচলিত আছে ৩ তলা জমিদার বাড়ির প্রথম তলা মাটির নিচে দেবে যায়। আসলে বিষয়টি এমন নয়। বাড়িটি ৩ তলা হলেও নিচের তলাটি ছিল সম্পূর্ণ মাটির নিচে। যা তৎকালীন জমিদাররা নিরাপত্তার জন্য বাঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করতো। এলাকায় জমিদার বাড়িটি ‘বাবুর বাড়ি’ হিসেবে বেশি পরিচিত ছিল। বাড়ির চারিদিকে দেড় হাত চওড়া প্রাচীর ছিল। সামনের দিকে ছিল বড় গেট। ভবনের সামনে ছিল একটি শান বাঁধানো বড় পুকুর। গরমের দিনেও তা শুকাতো না। এখনও সেই পুকুরটির অস্তিত্ব আছে, যদিও কালের বিবর্তনে পুকুরটি এখন ভরাট হয়ে কিছুটা ছোট হয়ে গেছে এবং গভীরতাও কমেছে।
পুকুরঘাটের বাম পাশে ৩৬ ইঞ্চি সিঁড়ি বিশিষ্ট দ্বিতল নহবত খানা ছিল। এখন নহবত খানার একটি মাত্র প্রাচীর বাদে বাকি সব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বাগান বাড়িসহ মোট ১২ বিঘা জমির উপর জমিদারবাড়িটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে এখন প্রায় সব জায়গা দখল হয়ে গেছে। ভবনটির দৈর্ঘ্য ২১০ ফুট, প্রস্থ ৩৭ ফুট। চন্দন কাঠের খাট-পালঙ্ক, শাল, সেগুন, লোহার দরজা ও জানালা, কড়ি, ১০ ইঞ্চি পুরু চুন-সুরকির ছাদ, মেঝেতে রয়েছে বিভিন্ন নকশা করা, বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় ছিল একটি বড় লোহার সিন্দুক। বিল্ডিংয়ের প্রতিটি পিলারের মাথায় গার্ডের মূর্তি ¯পন করা ছিল। অবশ্য এখন তার কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বাড়িতে ঢুকতে ৪টি গেট ছিল। প্রতিটি ছিল ২০ ফুট দূরত্বে। জমিদার পরিবার ভারতে চলে যাওয়ার পর বাড়িটির আর কোনো সংস্কার করা হয়নি। এমন ঐতিহাসিক একটা স্থাপনা এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে দূর দূরান্ত থেকে অনেক লোক জমিদার বাড়ি দেখতে আসতো, ছবি তুলতো। সবসময় এখানে মেলার মত হতো। এখন আর কেউ আসে না। কিছুদিন আগেও এখানে সন্ধ্যার পর মাদক আর জুয়ার আড্ডা বসতো। তবে এখন একটু কম। ১৯৫৪ সালে জমিদার পরিবারের আত্মীয় স্বজন বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর সরকারি বা বেসরকারি কোন সংস্থাই ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির সংস্কারের উদ্যোগ নেয়নি। চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অথচ এটাকে সংস্কারের মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র করা যেত। তবে এখনও যদি সরকারিভাবে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে পুরোপুরি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি।