দেশজুড়ে

লালনের তিরোধান দিবসে সাতক্ষীরায় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

  জিয়াউল ইসলাম জিয়া, বিশেষ প্রতিনিধিঃ ১৯ অক্টোবর ২০২৫ , ৪:১৭:২২

হেমন্তের শান্ত সন্ধ্যা। হালকা শীতল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বাউল সাধক ফকির লালন শাহের গান- মানুষের ভেদাভেদহীন মানবতার অম্লান সুর। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে লালন শাহের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত হয় এক মনোমুগ্ধকর আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’- এই চিরন্তন সুর যেন ছড়িয়ে পড়ে মিলনায়তনের প্রতিটি কোণে। উপস্থিত অতিথি, শিল্পী ও দর্শক- সকলেই যেন ডুবে যান লালনের ভাবধারায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিষ্ণুপদ পাল। প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা শিল্পকলা একাডেমির সদস্য সচিব মো. শাহিনুল ইসলাম, সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর বাসুদেব বসু, জেলা তথ্য অফিসার জাহারুল ইসলাম টুটুল, সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ বদরুদ্দোজা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিনুর চৌধুরী, এনডি ইশতিয়াক আহমেদ অপু, সহকারী কমিশনার শিক্ষা ও আইসিটি মোঃ তাজুল ইসলাম, কবি ও আবৃত্তিশিল্পী মাহমুদা শিরিন, বাউল শিল্পী মো. নুরুজ্জামান বাউলসহ স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যবৃন্দ। অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পীরা লালনগীতি পরিবেশন করেন।

আলোচকরা বলেন, ফকির লালন শাহ কেবল একজন বাউল সাধক ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানবতার এক চিরন্তন দার্শনিক। তাঁর গানে উঠে এসেছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে ভালোবাসায় বাঁচার বার্তা।

জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আজকের এই বিভাজিত সমাজে লালনের দর্শন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও ভেদাভেদের বেড়াজাল থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হলে লালনের মানবতার গান আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ হতে হবে।’

প্রফেসর বাসুদেব বসু বলেন, “লালন ছিলেন মুক্তচিন্তার প্রতীক। তাঁর গান কেবল সুর নয়—এটা মানুষ হবার শিক্ষা। যে মানুষ নিজের ভিতর মানুষ খুঁজে পায়, সেখানেই লালনের আসল সাধনা।”

আলোচনা পর্বের পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় শিল্পীরা পরিবেশন করেন একে একে “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”, “আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”, “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে”সহ জনপ্রিয় লালনগীতি।

শিল্পীদের প্রাণবন্ত পরিবেশনায় মুগ্ধ হয় দর্শক। আবৃত্তিশিল্পীরা পরিবেশন করেন লালনের দর্শনভিত্তিক কবিতা। নৃত্যশিল্পীরা দেহতত্ত্বের ভাবনায় মিশিয়ে পরিবেশন করেন মনোমুগ্ধকর নৃত্যনাট্য।

অনুষ্ঠান জুড়ে বারবার ফিরে আসে একটাই বার্তা- লালনের গান কেবল শিল্প নয়, এটি এক জীবনদর্শন। কুসংস্কার, ভেদাভেদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসকে পেছনে ফেলে মানুষ যেন মানুষকে ভালোবাসতে শেখে- এই ছিল আয়োজনের মূল লক্ষ্য।

শেষ পর্বে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন প্রধান অতিথি। আয়োজকরা বলেন, “প্রতিবছর আমরা চাই এই আয়োজনকে আরও বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যেতে, যাতে নতুন প্রজন্ম লালনের চিন্তা-দর্শন ও মানবতার আদর্শ জানতে পারে।”

সন্ধ্যার আবেশে মিলনায়তন যেন এক সৃষ্টিশীল আত্মার উৎসবে পরিণত হয়। দর্শকদের চোখে ছিল অনুপ্রেরণা, মনে ছিল মানবতার আহ্বান।

এই আয়োজন ছিল শুধু স্মরণ নয়, বরং প্রতিজ্ঞা- লালনের পথে এগিয়ে চলা, মানবতার বিজয় প্রতিষ্ঠা করা, এবং মানুষ হবার সাধনাকে জীবনের মূলমন্ত্র করে তোলা।

আরও খবর