টপ টেন

রেলের জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ: চুপ কর্মকর্তাদের মুখ!

  কাজী আতিক, খুলনা প্রতিনিধি: ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ১:১০:০৯

অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়া আইনশৃংখলা পরিস্থিতির সুযোগে খুলনায় রেলওয়ের জমি দখল করে তৈরি হয়েছে একাধিক মার্কেট, দোকান-পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও লাখ লাখ টাকায় হাতবদল হচ্ছে এসব দোকান। বিষয়টি জেনে বুঝেও ঘুষের বিনিময়ে মুখে কুলুপ এটেছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। ফলে সরকারি জমি দখল চলছে।

অভিযোগ রয়েছে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব কাজ তদারকি করছেন। মার্কেট বানানোর জন্য রেলওয়ে হাসপাতাল রোডের চিকিৎসক বাসভবন ‘ডাক্তার বাড়ি’ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙা হয়েছে পাশের রেলওয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর। জোড়াগেট রেলওয়ে কলোনীর ভেতরের একাধিক পুকুরও দখল করে ভরাট ও মাছ চাষ করছেন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা।

অভিযোগ রয়েছে, টাকার বিনিময়ে রেল কর্মকর্তারা তাদের সহযোগিতা করছেন। বিশেষ করে খুলনা কাছারির কানুনগোর বিরুদ্ধে সরাসরি এসব দখলদারদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশীর কর্মকর্তাদের কাছে পেঁৗঁছে দেন। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তারাও অবৈধ আয়ের একটি অংশ পান বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ভৈরব নদের তীরে ৬নং ঘাট এলাকার নগরবাসীর বিনোদনের জন্য পার্ক নির্মাণ করেছিল কেসিসি। পার্কের পাশেই ছিল বায়তুন নাজাত জামে মসজিদ। ২০২১ সালে মসজিদের সামনে ফাঁকা অংশে মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থানীয় মুসুল্লীরা বিষয়টি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সোহেলকে জানান। পরে শেখ সোহেলের নির্দেশে স্থাপনা ভেঙে দিয়ে জমিতে ঈদগাহের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে বালু ভরাট করে ঈদগাহ নির্মাণের প্রস্তুতি চলছিল। অভ্যুত্থানের পর ওই জমিতে ফের মার্কেট নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়। গত জুন মাসে সেখানে ১৬টি টিনের ঘর নির্মাণ করা হয়।

সরেজমিন গিয়ে ঘরগুলো ফাঁকা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। একটি ঘরের ওপর ইজারা গ্রহিতা তানভীর আহমেদ বাঁধন লেখা একটি সাইনবোর্ড ঝুলছিল। বাঁধন সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোল্লা ফরিদ আহমেদের ছেলে।
সূত্রটি জানায়, নগরীর রেলওয়ের চিকিৎসকদের বাসভবন ছিল রেলওয়ে মার্কেটের ভেতরে। স্থানীয়দের কাছে সেটি ‘ডাক্তার বাড়ি’ নামে পরিচিত। এর পাশেই রেলওয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে স্থানীয় কাউন্সিলর শামসুজ্জামান মিয়া স্বপন ভবনটি ভাঙার উদ্যোগ নিলে স্থানীয়দের বাঁধায় ব্যর্থ হন।

অভ্যুত্থানের পর কয়েক দফায় ভবনটির ছাদসহ বিভিন্ন অংশ ভেঙে ফেলা হয়। গত ৯ মার্চ ভবনের বাকি অংশ ভেঙে রাতারাতি সেখানে ১৪টি দোকান নির্মাণ করা হয়। দোকান নির্মাণের জন্য স্কুলের সীমানা প্রাচীর ভেঙে বেশ কিছুটা সরিয়ে নতুন প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।

সরেজমিন ঘুরে প্রাচীর ভাঙার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে কোনো সময় উচ্ছেদ করা হতে পারে-এমন আশংকায় দোকানগুলো কিনতে কেউ রাজি হয়নি। এজন্য পাকা স্থাপনাও তৈরি করা হয়নি।

বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, আশপাশের বাজারের সঙ্গে সংযোগ সড়ক থাকায় ওই ১৪টি দোকানের প্রতিটি ১৫/২০ লাখ টাকায় বিক্রি হবে।

রেলওয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, কারা ভেঙেছে জানি না। বিষয়টি নিয়ে আমরা থানায় অভিযোগ করেছি।

রেলওয়ের খুলনার ফিল্ড কাননুগো মো. সহিদুজ্জামান বলেন, ওই স্থান কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ডাক্তার বাড়ি ও পার্কের পাশে অবৈধভাবে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। খুব দ্রুত উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হবে।

সূত্রটি জানায়, ১৯৯৫ সালে খুলনা নগরীর পাওয়ার হাউজ মোড়ে রেলওয়ের জমি দখল করে ‘সাদ মনি মার্কেট’ নির্মাণ করেছিলেন দেশের আলোচিত ক্রমিক খুনি এরশাদ শিকদার। ২০০২ সালে এরশাদ শিকদারের বিচার চলাকালে অবৈধভাবে নির্মাণ করা মার্কেটটি ভেঙে দেয় প্রশাসন। ২৩ বছর পর সেই জমিতে নতুন মার্কেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। জমিটি ২১নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি নাজির উদ্দিন আহমেদ নান্নুর নামে ইজারা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নিলে রেলওয়ে সেখানে বাঁধা দেয়। সম্প্রতি সেখানে আরও এক বিএনপি নেতা মার্কেট নির্মাণ করছেন।
এছাড়া পুরাতন রেলস্টেশনের সামনে সেনাবাহিনীর মালামাল নামানোর জায়গাটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত ছিল। সেখানে ১২টি নতুন দোকান দেখা গেছে। প্রতিটি দোকানের ভাড়া ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে। অথচ এসব স্থাপনা থেকে রেলের প্রাপ্তি শূন্য।

ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ‘মামুর আস্তানা’র পাশে ভৈরবী নামে রেস্টুরেন্টের পেছনে প্রায় ১০ বিঘা জমিতে মেলা বসিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে কলোনীর ভেতরে বেশকিছু পুকুর দখল করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। স্টেশন রোডে মশিউর রহমান মার্কেটের পাশে রেলওয়ের গাড়ি চালকের ভবন ভেঙে সেখানেও বেশকিছু দোকান নির্মাণ করে বিক্রি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে রেলওয়ের খুলনার ফিল্ড কাননুগো মো. সহিদুজ্জামান বলেন, কোনো ধরনের অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে রেলের কেউ জড়িত নয়। অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের পরিস্থিতির বিষয়ে সবাই জানেন। অনেক জায়গায় বাঁধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবৈধ স্থাপনার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এগুলো উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হবে।

আরও খবর