আইন-আদালত

চট্টগ্রামে গণপিটুনিতে এক বছরে ৮ জনকে হত্যা

  মোঃ সেলিম উদ্দিন খাঁন, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: ২৫ আগস্ট ২০২৫ , ১০:৩৫:৫১

ফটিকছড়ির কাঞ্চননগরে গত ২১ আগস্ট দিবাগত রাতে তিন কিশোরকে আটক করা হয় একটি সেতুর পাশে, চারদিক অন্ধকার। হঠাৎ চিৎকার ‘চোর ধর, চোর ধর’। মুহূর্তেই চারপাশ থেকে কয়েকজন ছুটে আসেন। অতঃপর তাদের গলায় বাঁধা হয় দড়ি। কেউ গালাগাল দেন, কেউ আবার লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকেন।কিন্তু কেউই শোনেননি তিন কিশোরের মিনতিÑ‘আমরা চোর নই, বাড়ি ফিরছি শুধু’। কিন্তু জনতার হাতে যে ‘আইন’! কিছুক্ষণের মধ্যেই লুটিয়ে পড়ে রিহান মাহিন (১৫)। তার দুই বন্ধু মো. মানিক ও মো. রাহাত আহত হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। একদিন পর জানা গেল তারা আদৌ কোনা চোর নয়। তিনজনই ছাত্র।এসব দৃশ্য যেন চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে আইন-আদালত নয়, ‘সন্দেহ’ই হয়ে উঠছে মৃত্যুদণ্ডের রায়। গত এক বছরে এখানে এমন গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন। কারো বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ, কারো বিরুদ্ধে ডাকাতির সন্দেহ, আবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার হাতিয়ারও হয়েছে ‘গণপিটুনি’। পিটিয়ে হত্যা করা মাহিন কাঞ্চননগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল এবং একই গ্রামের সাগর আলী তালুকদার বাড়ির মুদি দোকানি মো. লোকমানের ছেলে। আহত রাহাত এলাকার গাউসিয়া হজ কমিটি শাহেনশাহ বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানের ১০ম শ্রেণির ছাত্র। আর মানিক কাঞ্চননগর রুস্তমিয়া মুনিরুল ইসলাম দাখিল মাদরাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আহত দুজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। পরিবার জানায়, তিন বন্ধুই বৃহস্পতিবার সকালে বেড়াতে কক্সবাজার গিয়েছিল। রাতে সেখান থেকে ফিরে বাসায় যাওয়ার পথে ওই গণপিটুনির শিকার হয়।মা খাদিজা বেগমের বুকফাটা আর্তনাদ যেন গোটা কাঞ্চননগরে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার রিহান তো চোর ছিল না। সে ১৮ পারা কোরআন মুখস্থ করেছে। নামাজ পড়ত, মসজিদে যেত। আমি নিজ হাতে ওকে স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করালাম, যাতে পড়াশোনা করে মানুষ হয়। সেই ছেলেকে আজ মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কেড়ে নিলো আমার বুক থেকে। মাহিনের বাবা ভাঙা গলায় বলেন, ওরা বলল মাহিন নাকি টাকা চুরি করেছে। আমি হাত জোড় করে বলেছি, যদি টাকা নিয়ে থাকে, আমি ফেরত দেব। আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও। কিন্তু কেউ শোনেনি, কেউ করুণা করেনি। আমার অনুনয় তাদের কানে পৌঁছায়নি। শেষ পর্যন্ত আমার ছেলেকে বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলল।অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে মা খাদিজা আর্তনাদ করে বলেন, আমার চোখের সামনের অজস্র স্বপ্ন ভেঙে গেল। যে ছেলেটা একদিন কোরআনের হাফেজ হবে বলে আমি স্বপ্ন দেখতাম, সেই ছেলেকে আজ কবরে শুইয়ে দিতে হলো। আমি প্রশাসনের কাছে এর বিচার চাই। আমার বুকের ধনকে যেভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, তার প্রতিটি আসামির ফাঁসি চাই। আহত রাহাতের মামা আনোয়ার হোসেন সুমন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ভাগিনা কোনো চোর নয়। ওরা তিনজন এলাকারই ছেলে, সবাই চেনে। সেদিন শুধু কক্সবাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। অথচ কিছু লোক মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে তাদের ধরে পিটিয়ে মারল। রিহানকে মেরে ফেলল, আমার রাহাত আর মানিক এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।তিনি আরো বলেন, আমি হাসপাতালে গিয়ে রাহাতকে দেখেছি। ওর শরীরের সর্বত্র আঘাতের চিহ্ন। কথা বলার মতো শক্তি নেই। শুধু কষ্টে ফিসফিস করে বললÑমামা, আমি তো কিছু করিনি, কেন মারল আমাকে? এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি।আনোয়ার হোসেন সুমন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা পরিকল্পিত হত্যা। ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে ওদের ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা এই নৃশংস কাজ করেছে, তাদের শাস্তি না হলে আর কোনো ছেলে নিরাপদ থাকবে না। নিহত মাহিনের মা খাদিজা বেগম এ ঘটনায় ফটিকছড়ি থানায় মামলা করেছেন। মামলায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে আরো সাতজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্তদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলো মুহাম্মদ নোমান (২২) ও মুহাম্মদ আজাদ (২৩)। দুজনই কাঞ্চননগর ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চননগর গ্রামের বাসিন্দা। বাকি তিনজন নাজিম উদ্দিন, মোহাম্মদ তৈয়ব ও মহিউদ্দিনকে ধরতে অভিযান চলছে। ফটিকছড়ি থানার ওসি নুর আহমদ বলেন, চুরির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। মব সৃষ্টি করে এ ঘটনা ঘটনো হয়। আমরা দুজনকে গ্রেপ্তার করেছি। বাকিদেরও শিগগির গ্রেপ্তার করা হবে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, চোর সন্দেহ নয়, পূর্বের বিরোধ থেকেই হামলা চালানো হয়েছে। শুধু ফটিকছড়ি নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রামে অন্তত আটজনকে মব সৃষ্টি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার দেশ এক বছরের ‍পরিসংখ্যান ঘেঁটে ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জেনেছে।গত বছরের আগস্টে চট্টগ্রামের ষোলশহর ২ নম্বর গেটে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মো. শাহাদাত নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এক মাস পর সে ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়ায়। তাতে দেখা যায়, ২৪ বছরের শাহাদাত হোসেনকে মারধরের সময় কয়েকজন লোক গান গাইছে ও নাচছে।
নিহত শাহাদাত নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার নাদনা গ্রামের বাসিন্দা। শহরের বিআরটিসি এলাকায় থাকতেন এবং একটি ফলের দোকানে কাজ করতেন।
পরদিন তার চাচা হারুন বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার ওসি (তদন্ত) মো. সাজ্জাদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, ওই ঘটনায় ভিডিও দেখে প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে প্রধান আসামি স্বীকারোক্তি দিয়েছে। কদিনের মধ্যে চার্জশিট দেওয়া হবে।চলতি বছরের ৩ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় তারাবির নামাজ শেষে মসজিদের মাইকে ঘোষণায় লোক জড়ো করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় জামায়াতকর্মী নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ ছালেককে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গণপিটুনিতে মো. রফিক নামে এক বিএনপি নেতাকে হত্যা করা হয়। রফিক উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের কাজীর তালুক এলাকার মৃত তাজুল ইসলামের ছেলে।এ বছরের ২৭ জুলাই নগরীর চান্দগাঁও থানার কালুরঘাটের খেজুরতলা এলাকায় ছিনতাই করে পালানোর সময় এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গণপিটুনিতে নিহত ব্যক্তির নাম মো. ইকবাল হোসেন রুবেল। তার বিরুদ্ধে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের ১৫টি মামলা রয়েছে।
চলতি বছরের মার্চে চট্টগ্রামের রাউজানে কমর উদ্দিন জিতু নামে এক যুবদল কর্মীকে ছুরিকাঘাত ও গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। কমর উদ্দিন হলদিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর সর্ত্তা গ্রামের আলহাজ মুহাম্মদ আলীর ছেলে।এছাড়া চলতি বছরের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজানে গরুচোর সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে মো. রবিউল হোসেন (৩৬) নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়। রবিউল নগরের বায়েজিদ এলাকার নুরুল আলমের ছেলে।এছাড়া গত ৫ আগস্ট নগরের পতেঙ্গায় আরো একজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। তার নাম-পরিচয় জানা যায়নি।চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মাহমুদা বেগম আমার দেশকে বলেন, পুলিশের টহল টিম বাড়ানো হয়েছে। ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলেই দ্রুত রেসপন্সের জন্য পুলিশ সদস্যরা দিনরাত কাজ করছেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

আরও খবর