আইন-আদালত

এত মধু চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে, দীর্ঘদিন ধরে গেড়ে বসা অসাধু কিছু কর্মচারীর দুর্নীতি

  মো. সেলিম উদ্দিন খাঁন, চট্টগ্রাম ব্যুরোঃ ৭ অক্টোবর ২০২৫ , ৫:১৬:৪৩

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে গেড়ে বসা ‘অসাধু’ কিছু কর্মচারীর দুর্নীতি ও দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন বেশ কিছু কর্মচারী। তাদের বদলি পদোন্নতি হলেও নানা অজুহাতে বছরের পর বছর থেকে যাচ্ছেন নিজেদের পছন্দের দপ্তরে। তথ্যসূত্রে জানা যায় প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক শোয়েব মোহাম্মদ দুলু। টানা সাত বছর ধরে কর্মরত আছেন সরকারি এই দপ্তরটিতে। ২০ বছরের সরকারি চাকরিজীবনের প্রথমে রাজস্ব শাখা, তারপর রেকর্ড রুম, ফের রাজস্ব শাখা, এরপর চান্দগাঁও ভূমি অফিস এবং সব শেষে বর্তমানে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ‘মধু শাখা’ খ্যাত কয়েকটি লোভনীয় দপ্তরের মধ্যে তালিকার শীর্ষে থাকা এলএ শাখায় কর্মরত। বিভিন্ন সময়ে ঘুরেফিরে ভূমি ও রাজস্ব-সংক্রান্ত দপ্তরেই চাকরি করছেন এই অফিস সহকারী। আরেক অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মোহাম্মদ আলী হোসেন। গত সাত বছর ধরে কর্মরত জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগের এসএ শাখায়। তিনিও ২০ বছরের চাকরিজীবনে ঘুরেফিরে বারবার কর্মরত ভূমি-সংক্রান্ত দপ্তরেই। এর মধ্যে মহানগরের সদর সার্কেল, বাকলিয়া সার্কেল এবং আবারও সদর সার্কেলে চাকরি করেন। সব শেষ দীর্ঘদিন ধরে আছেন এসএ শাখায়। অবশ্য শুধু এই দুজনই নন, একইভাবে নানামুখী তদবির ও অর্থের লেনদেনে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এবং মহানগর-জেলার ভূমি ও রাজস্ব-সংক্রান্ত বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেফিরে বহাল তবিয়তে রয়েছেন ২০ জনের বেশি কর্মচারী। তাদের অনেকের শক্তি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। বদলি হলেও নানা অজুহাতে বছরের পর বছর থেকে যাচ্ছেন নিজেদের পছন্দের দপ্তরে। পদোন্নতি কিংবা বদলিতেও তারা নড়েন না। এসব আলোচিত কর্মচারীর বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে উল্টো নিজেদেরই বিপদের মুখে পড়তে হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন বছরের বেশি সময় একই কর্মস্থলে থাকতে পারেন না। অভিযোগ আছে, অল্প বেতন পেলেও এসব কর্মচারীর বেশিরভাগই কাঁরি কাঁরি টাকার মালিক হয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত চলছে দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক)। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অফিস আদেশসহ এ-সংক্রান্ত বেশকিছু নথিপত্র হাতে এসেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন খবর অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিবিধি অনুযায়ী চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও এর অধীন কার্যালয়গুলোতে কর্মরতদের তিন বছর পর বদলির নিয়ম রয়েছে। সে অনুযায়ী ডিসি, এডিসিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়মিত বদলি হচ্ছেন; কিন্তু জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ২০ জনের বেশি কর্মচারী বছরের পর বছর ঘুরে ফিরেই জেলা প্রশাসনের ভূমি ও রাজস্ব-সংক্রান্ত বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত। কালেভদ্রে কখনো বদলি হলেও অল্প সময়ে তারা ফের তদবির করে ফিরে আসেন আগের পদে। আর এমন অনিয়ম ঠেকাতে বদলিতে লটারি পদ্ধতির প্রচলন করা হলেও তদবির বা ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ভুল বুঝিয়ে সেখানে থাকে না তাদের নাম। জনশ্রুতি রয়েছে যে, একজন কর্মচারী যে কোনো দুটি ভূমি অফিসে টানা চাকরি করতে পারলে তাকে আর ধন-সম্পদের জন্য পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। বলা হয়, তখন টাকাই তার পেছনে ঘুরে।এসব কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে জেলা প্রশাসনের ভূমি-সংক্রান্ত দপ্তরেই চাকরি করছেন। কখনো ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, কখনো সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় আবার কখনো রেকর্ড রুমে। এভাবে সুবিধাজনক শাখায় চাকরি করার সুযোগে তারা জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়মে, পকেটে ভরেন কাঁরি কাঁরি টাকা। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো. শারুক হোসেন কর্মরত পতেঙ্গা সার্কেল ভূমি অফিস। তিনিও ২০ বছরের চাকরিজীবনে ঘুরেফিরে কাজ করেছেন মহানগরের একমাত্র সদর ভূমি অফিস এবং চান্দগাঁও ভূমি অফিসে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের আগ্নেয়াস্ত্র শাখার উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা আরিফ হোসেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি এ শাখায় কর্মরত আছেন ১০ বছর ধরে। এর আগে ছিলেন রেকর্ড রুম, চান্দগাঁও ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে। একই শাখায় ১০ বছর ধরে চাকরি করলেও গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বদলি লটারিতে তার নাম আসেনি। লটারির তালিকায় তার নামই দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক মুহাম্মদ নূরুল কাদের। তিনি জেএম (জুডিসিয়াল মুন্সিয়ানা) শাখায় কর্মরত আছেন ৮ বছর ধরে। এর আগে কর্মরত ছিলেন রেকর্ড রুম ও এলএ (ভূমি অধিগ্রহণ) শাখায়। দীর্ঘদিন জেলা প্রশাসনের জেএম শাখায় চাকরি করলেও অজানা কারণে বদলি লটারিতে তার নাম দেওয়া হয়নি। ফলে তিনি বদলিও হননি। আরেক অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো. সাইফুর রহমান। বর্তমানে কর্মরত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (এডিএম) গোপনীয় শাখায়। এ শাখায় তিনি আছেন এক দশক ধরে। গত এপ্রিলে হওয়া বদলির লটারিতে তার নাম ওঠে জেএম শাখায় পদায়নের। অথচ এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন এডিএমের গোপনীয় শাখায়। আর এর আগে ছিলেন জেলার চান্দগাঁও ভূমি অফিসে। জেলা প্রশাসনের উপ-সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী। ‘লোভনীয়’ দপ্তর হিসেবে পরিচিত এলএ শাখায় ছিলেন টানা আট বছর। দুই মাস আগে তাকে বদলি করা হয় পর্যটন সেলে; কিন্তু গত ১৫ সেপ্টেম্বর তাকে সেই দপ্তর থেকে ফিরিয়ে এনে পদায়ন করা হয় ট্রেজারি শাখায়। চাকরি জীবনে তিনি চান্দগাঁও ও সদর ভূমি অফিসসহ ভূমি-সংক্রান্ত সরকারি দপ্তরগুলোতেই ঘুরেফিরে টানা কর্মরত ছিলেন। বদলির জন্য লটারি করা হলেও সেখানে তার নাম আসেনি। জেলা প্রশাসনের উপসহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেন টানা ১৫ বছর ছিলেন এল শাখায়। অবশ্য গত ১৭ জুলাই তাকে বদলি করা হয় পিএস রেকর্ডরুম শাখায়। দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমানে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। রাউজানের সহকারী কমিশনার (ভূমি), যা এসিল্যান্ড অফিস নামে পরিচিত, সরকারি এই দপ্তরটির সার্টিফিকেট সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন নুরুল আফসার। চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফরিদা খানম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে নুরুল আফসারকে চন্দনাইশ বদলি করা হলেও ২১ দিন পরও নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি তিনি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে গেড়ে বসা এসব ‘অসাধু’ কর্মচারীর দুর্নীতি ও দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন অন্যান্য সাধারণ কর্মচারীরা। তারা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সরকারি চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করে ভূমি-সংক্রান্ত দপ্তরগুলোতে কর্মচারীদের বছরের পর বছর টানা কর্মরত থাকা এবং বদলি আদেশের পরও নতুন কর্মস্থলে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শরীফ উদ্দিনের কাছে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিন খবরকে বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মচারী তিন বছরের বেশি একই জায়গায় চাকরি না করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সার্কুলার আছে। এ ব্যাপারে আমরা অবগত। তাছাড়া, জেলা প্রশাসনের অধীনে অফিস-
বিভাগগুলোতে পদায়ন ও বদলিতে শৃঙ্খলা আনতে লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটি একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। তবে বর্তমানে এক জায়গায় তিন বছরের বেশি কর্মরত বা আদেশ হওয়ার পরও বদলি না হওয়ার বিষয়ে সুষ্পষ্ট তথ্য আমার কাছে নেই। এ ব্যাপারে আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক নেই। তবে আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নতুন জেলা প্রশাসক আসলে একই পদে যারা তিন বছরের বেশি কর্মরত আছেন, তাদের সবাইকে নিয়মমতে বদলি করার জন্য। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তাছাড়া এরই মধ্যে বদলি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেকের বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগের তদন্ত চলমান আছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে কারও বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও খবর